ভাষামৃত

wordcloudbhasha

বেশ কয়েকবছর আগের কথা।টেবিলময়  বাংলা  অক্ষর গুলো ছড়ানো। অক্ষর গুলো মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে   আমার বছর তিন -চারের  ছোট্ট কন্যার কাছে।এবার “ওই অজগর” বলতে বলতে অক্ষর সাজানোর পালা।আপন মনে সাজাতে গিয়ে এবার কন্যার  চিৎকার, “মা, ঠাকুরদাদা হারিয়ে গেছে”! দৌড়ে এলাম ।দেখি প্রাণপনে “ঠ” কে খোঁজা চলছে একবার টেবিলের ওপরে আরেকবার টেবিলের নীচে।টিয়া পাখির ঠোঁট টি লাল/ঠাকুরদাদার শুকনো গাল…।ট য়ে  ঠ য়ে ঠোকাঠুকি করতে করতে বাংলা ভাষার সঙ্গে মোলাকাত  শুরু।অবাঙ্গালী পরিবেশে  অন্যান্য ভাষার সঙ্গে মাতৃভাষার পাঠ নেওয়াটা একটু সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।কিন্তু এমন  বিশাল বাংলা ভাষা সাহিত্যের অমৃত কুম্ভের  স্বাদ গ্রহণে  সে যেন  বঞ্চিত না হয়  তার চেষ্টা  চালিয়ে গেলাম।সেই কষ্টার্জিত বিদ্যা প্রদর্শনের সু্যোগও কখন সখন এসে গেছে প্রবাসী বাঙ্গালীদের আয়োজিত সরস্বতী পুজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই হোক বা পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে।এই দিন গুলোতে দেখেছি সবাইকে শিশুসুলভ আনন্দে মেতে উঠতে শুধুমাত্র বাংলা সংস্কৃতি কে আঁকড়ে ধরে।হয়তবা মূল স্রোত থেকে দূরে থাকার কারনেই, শুধু মাত্র ভাষাটাকে প্রাণভরে শোনার জন্যই একটা চোরাটান কাজ করে ।অবশ্যই এই উপলব্ধি একান্তই আমার কেননা এমন অনেকই আছেন যারা আশৈশব অবাঙ্গালী পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার দরুণ  এই টিপিক্যাল বাঙালি ভাবাবেগ তাদের মধ্যে কাজ করে না বা  তারাও ঠিক করে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনা।কিন্তু যত মুস্কিল তো শেকড় সমেত উপড়ে এনে নতুন মাটিতে লাগানো গাছের,অত সহজে কি আর পুরানো মাটি শেকড় থেকে আলগা হতে দিতে পারে!তাই চারা গাছ কেও একটু উৎসাহ ভরে নিজের ভাষা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর চেষ্টা চালিয়ে যাই। ভাষার সঙ্গেই তো  জড়িয়ে থাকে অস্তিত্ব,পরিচিতি এবং সংস্কৃতি। নিজের গন্ডীর বাইরে পা ফেললেই প্রথম  পরিচয় শুরুই হয় ভাষারই হাত ধরে ।নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে গেলে অন্তত নিজের ভাষাটা তো  ঠিক করে জানা চাই।

হঠাৎ করে বাংলা ভাষা নিয়ে কেন পড়লাম? পয়লা বৈশাখের  আর বেশী দেরী নেই। ইনবক্সে ইতিমধ্যেই শাড়ীর দোকান গুলো থেকে ঝপাঝপ চিঠি আসছে শাড়ী কেনার প্রলোভন দেখিয়ে। বাংলার বাইরে  এই  পয়লা বৈশাখ আর দুর্গাপুজা এলেই  নতুন উদ্যমে সবাই নিজেদের বাঙ্গালী সত্তা টাকে একটু রিনিউ করে নিই।বর্তমানের বিভিন্ন “ডে” যেমন ভ্যালেন্টাইনস ডে,ফ্রেন্ডশীপ ডে,মাদারস ডে, ফাদারস ডে যতই সারাবছর ক্যালেন্ডার জুড়ে দাপিয়ে বেড়াক,আমাদের এই পয়লা বৈশাখ “ডে” এখন ও  বাঙ্গালীর কাছে এক নম্বর “ডে”। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে  পয়লা বৈশাখ উদযাপনের রকম সকমও ব্যক্তিগত জীবনে পরিবর্তন হয়েছে । সেই ছোটবেলার মত  আত্মীয়স্বজনের বাড়ী গিয়ে প্রণাম ও মিষ্টিমুখ করার সু্যোগ আর  নেই।বা  বাড়ীতে  এই উপলক্ষে হঠাৎ করে অতিথি সমাগম হবে বিনা নোটিসে, সে সম্ভাবনাও নেই। শৈশবের সেই নতুন জামা পরে  আনন্দ হুল্লোড়ে মাতামাতি আর খাওয়া দাওয়া , সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে  বাবার কোলাকুলির দৃশ্য অবাক হয়ে দেখা, রান্নাঘরে মায়ের অতিরিক্ত ব্যস্ততা, দুপুরে সবাই মিলে বসে পুরোপুরি বাঙালি রান্না তৃপ্তি করে খাওয়া এই  টুকরো টুকরো স্মৃতি গুলো বার বার রোমন্থন করতে এখন সুখ বোধই হয়।উদযাপন তখন ছিল অনায়াস । একটাই প্যাটার্ন ছিল বছরের পর বছর ধরে। বিকল্প  কিছু ছিলনা। না রান্নায়(বাঙ্গালী হেঁসেলে তখন ও বিপ্লব ঘটেনি) না জীবনযাত্রায়। তবু এখনও সেই দিন গুলিই মনে  মনে “মিস”করি।

পরবর্তী কালে পয়লা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভবিষ্যৎ বাণী সম্বলিত পঞ্জিকা আর চৈত্র সেলের বাজার।বছর শেষে সেই ভবিষ্যৎবাণী  কতদুর ফললো তা নিয়ে কারোরই তেমন মাথা ব্যথা হতো বলে মনে হয় না।বরঞ্চ শুরু টা নিয়েই যত চিন্তা।এই পঞ্জিকার মাধ্যমেই খনার বচন প্রথম পড়লাম আর ছোট ছোট দু লাইনের ছড়ার মাধ্যমে কখন কি গাছ লাগাতে হয় জানলাম। সেই বিদ্যা কখন সখন পরে যে ফলাইনি তা কিন্তু নয়।”ডাক ছেড়ে বলে রাবণ/ কলা রোবে আষাঢ শ্রাবন” বা  ভাদরে করে কলা রোপন/স্ববংশে মরিল রাবণ”।এই সব ছড়ার আবেদন তো চিরকালীন ।

চৈত্র সেলের বাজার তো সবচাইতে  খতরনাক এলাকা! ভীড়,গাদাগাদি ঠেলে ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে সস্তায় জিনিস কেনার হিড়িক ,যার মেয়াদ কাল নিয়ে যথেষ্ট সংশয়  খোদ  ক্রেতার মনেও থাকে ,তবু এক অমোঘ আকর্ষণের টানে ঢল নামত বাজারে। এখন শপিং মল গুলোতে  প্রায় সারাবছরই নানা ছুঁতোয় সেল চলে বা লোকের ক্রয় ক্ষমতা  বাড়ার দরুণ সারাবচ্ছর  জুড়েই কেনাকাটা চলে। কিন্তু সে তো মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের জন্যে। আর  নিম্নবিত্ত বা গরীব ঘরের  জন্যে এই চৈত্র সেল এখন ও একমাত্র জায়গা সস্তায় কাপড় কেনার। তাই এর জনপ্রিয়তা কমবে বলে মনে হয় না।খালি ক্রেতা নয়,ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ও এর মুল্য অনেক। বড় বড় দোকান গুলো থেকে ক্রেতাদের দেওয়া হত ,বাংলা ক্যালেন্ডার।সেই  ক্যালেন্ডারের দশা অনেকটা ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলোর মত, সারাবছর  দেওয়ালের এক কোণে অনাদৃত  অপাংত্তেয় হয়ে পড়ে থাকা আর পুজা পার্বণ আচার অনুষ্ঠানের সময় হাঁক পেড়ে টেনে নামানো,” দেখ তো পুজা টা কবে পড়ল” ইত্যাদি ইত্যাদি।তবে একটা জিনি্স লক্ষ্য করতাম আমরা যতই ইংরেজী সন তারিখ অনুসরণ করিনা কেন, বাজার হাটে দোকানীরা,  চাষীরা, গৃহপরিচারিকারা  বা জন মজুরেরা সবাই কিন্তু বাংলা সন তারিখ আর মাসটাকেই রীতিমত অনুসরণ করে ।সেই ট্র্যাডিশন এখন ও চলছে কিনা ঠিক বলতে পারিনা  ।সময় বদলায়,প্রয়োজন বদলায়।  আর সব বদলের মাঝে আমরাও ধীরে ধীরে বদলাচ্ছি।

প্রসঙ্গত বলি, আমার এক মারাঠী বান্ধবীর সঙ্গে সেদিন গল্প করছিলাম। সে খুব মারাঠী নাটক দেখতে ভালবাসে। তার কাছে মারাঠী নাটক সম্পর্কে জানতে চাইলাম, সেও  মহানন্দে আমাকে অনেক কিছু বলল তার পর যা হয় নাটক থেকে সাহিত্য ,ভাষা সংস্কৃতি সব বিষয় নিয়ে আড্ডা জমে উঠল।কিন্তু একটা কথা শুনে বড় গর্ব হল যখন বলল, তোমাদের বাংলা ভাষার মত এত সাহিত্য সম্ভার আমাদের নেই, আমার শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ পড়তে ইচ্ছে করে,তোমাদের ভাষায় কত বড় বড় সাহিত্যিক ! একথা অনস্বীকার্য্য  সিনেমা বা টিভি তে বাংলা সাহিত্য নির্ভর  গল্প দেখেই এরা আকৃষ্ট হয়েছে বাংলা ভাষার প্রতি।  আমিও আমার সাধ্যমত বাংলার সাহিত্যিক ও তাদের  লেখা সম্পর্কে একটু  আভাস দিলাম।  এক অবাঙ্গালী বন্ধুর কাছে নিজের ভাষা সম্পর্কে অল্প কিছু জানাতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করলাম। মনে হল  আমাদের উত্তরসুরীরাও নিজেদের মাতৃভাষাটা ভাল বাসুক,ভাল করে জানুক ,এত সুন্দর  এবং সমৃদ্ধ একটা ভাষার সাহিত্য পড়তে উৎসাহী হোক।

2 Comments Add yours

  1. jayatisblog says:

    নতুন বাংলা বছররের অনেক শুভেচ্ছা জানাই। না রে এখনও সড়গড় হয়নি, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

    Like

  2. great job. Be the brand ambassador of Bangla.
    I should have been writing in bangla but unfortunately my laptop doesn’t support that font.
    I am sure your daughter is proficient in bangla.
    Wish you a great Poila Boishakh day in advance.

    Like

Leave a comment