প্রকৃ্তির কোলে মহাবলেশ্বরে

মহাবলেশ্বর পুনে থেকে ১২০ কিমি দূরে ।দূরত্বের হিসেবে খুবই সামান্য দূর। বেশ কিছু বছর আগে তখন সবে সবে পুনেতে পাকাপাকি ভাবে এসে পড়েছি সেসময় একবার  একদিনের ট্রিপে মহাবলেশ্বরকে ছুঁয়ে দিনেদিনেই ফিরে এসেছিলাম। কি দেখেছিলাম সে আর মনে নেই কেননা একটা দুটো ছবি তোলা হয়েছিল,কন্যাও তখন নেহাত শিশু আর আমার ভ্রমণ প্রিয় জেঠু পুনের আশপাশ দেখবেন বলে মনস্থির করলেন তখন ঝটিকা সফরে সদলবলে ছুটে ছুটে একদম মহাবলেশ্বর দর্শন করে এসেছিলাম। তখন নতুন জায়গা দেখার আগ্রহ ছিল কিন্তু  সেখানকার ইতিহাস নিয়ে কিছু জানার সময় বা সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এবার যখন ঠিক করলাম মহাবলেশ্বর যাব তখন মহাবলেশ্বরের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে মহাবলেশ্বরের ওপর একটা মূল্যবান বই খুঁজে  পেলাম। লেখক হলেন ইতিহাসবিদ রাও বাহাদুর দত্তাত্রেয় বলবন্ত পারাসনিস বা ডি বি পারাসনিস  ( ১৮৭০-১৯২৬)। মহাবলেশ্বরের  ওপর লেখা এটা একটা প্রামান্য গ্রন্থ । ব্রিটিশ শাসন কালে বোম্বে  প্রেসিডেনসিতে পশ্চিম ভারতে  সাহেব সুবোদের  গ্রীষ্মকালীন  স্যানিটেরিয়াম  হওয়ার প্রস্তুতি পর্বে মহাবলেশ্বর কেমন ছিল তার একটা বিবরণ পাই। সেই বই বগলদাবা করে বেড়িয়ে পড়লাম মহাবলেশ্বর দর্শনে। পুনে থেকে গাড়িতে তিন সাড়ে তিন ঘন্টার পথ। আমরা  তিনজন, কর্তা, গিন্নি আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সকাল সকাল গ্যাঁট হয়ে বসে পড়লাম “সওয়ারী”র গাড়িতে।  রাস্তায় একবারই ক্ষণিকের চা পানের বিরতি নিলাম আর চললাম জাতীয় সড়ক ৪৮ ধরে।

পথে পড়ল ওয়াই (Wai)শহর। এই ওয়াই শহর দিয়ে বয়ে গেছে  কৃষ্ণা নদী  যার উৎপত্তি মহাবলেশ্বরে। ওয়াই শহরে রয়েছে অসংখ্য  মন্দির আর তাই একে দক্ষিণ কাশীও বলে। এই শহরের পরেই শুরু হয় ঘাট  বা ঘোরানো  পাহাড়ি রাস্তা। পাহাড়ে যতই চড়ছি জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ল পশ্চিমা ঘাটের পর্বত মালা, নীচে বিন্দুর মত দেখতে ওয়াইএর জনপদ। মহাবলেশ্বর সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪৫০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এবং প্রাচীন কালে হিন্দু তীর্থ  বলেই খ্যাত ছিল এবং মহারাষ্ট্রে ক্ষেত্র মহাবলেশ্বর নামেই পরিচিত ।প্রতি বারো বছর অন্তর বৃহস্পতি যখন কন্যা রাশিতে(Virgo)  গোচর করেন তখন একে বলে কন্যাগত আর এই সময়ে পুণ্যার্থীরা ক্ষেত্র মহাবলেশ্বরের কৃষ্ণা নদীতে অবগাহন করে মন্দিরে পূজা দেন। কথিত আছে শিবাজী ও তাঁর মা জিজাবাঈ ও এখানে আসতেন এবং এখানে্র মন্দিরে বাৎসরিক অনুদান দিতেন ।পরবর্তীতে শিবাজীর বংশধরেরা, পেশোওয়া এবং মরাঠা সর্দারেরা তীর্থযাত্রায় এখানে আসতেন।

১৭৯১ সালে পেশোওয়া সওয়াই মাধব রাও এবং মন্ত্রী নানা ফডনবিস মহাবলেশ্বরে আসেন আর তাঁদের সঙ্গে এসেছিলেন স্যার চার্লস ম্যালেট যিনি তখন পুনা দরবারের প্রথম ব্রিটিশ রেসিডেন্ট । ১২ই অক্টোবর ১৭৯১, সেদিন  ছিল চন্দ্র গ্রহণ আর যাত্রা উৎসব। ওয়াই এ এসে দুদিন পরে অর্থাৎ ১৪ই অক্টোবর এক বিশাল পুণ্যার্থী দল নিয়ে পেশোয়ারা মহাবলেশ্বরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেই অর্থে স্যার ম্যালেট হলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি মহাবলেশ্বরে পা রাখেন। স্যার ম্যালেট  সহ  পেশোয়াদের বিরাট কনভয় মহাবলেশ্বরের পাহাড় বেয়ে চলেছে এই দৃশ্য কল্পনা করতে করতে গাড়িতে করে এগিয়ে চললাম পাঞ্চগণির দিকে। বর্তমানের পাঞ্চগণি বিখ্যাত তার বোর্ডিং স্কুলের জন্য,রয়েছে বিখ্যাত টেবিল ল্যান্ড মালভূমি বা plateau। পাঞ্চগণি থেকে মহাবলেশ্বর এর দূরত্ব প্রায় ১৯ কিমি। 

দেখতে দেখতে আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম মহাবলেশ্বরে মহারাষ্ট্র টুরিজমের রিসর্টে। শহরের  কেন্দ্র থেকে ২ কিলোমিটরের মধ্যে একদম  জঙ্গলে ঘেরা নির্জন শান্ত পরিবেশে যেখানে একমাত্র আওয়াজ যা কানে আসে তা হল পাখির গান। মুগ্ধ হয়ে গেলাম রিসর্টের  অবস্থান দেখে।প্রায় ৪৫ একর জুড়ে এই রিসর্ট একটা হেরিটেজ এলাকা। ব্রিটিশ আমলে বানানো বিভিন্ন রকমের বাংলো  রিসর্টের ভেতরে রয়েছে। কোনটার  নাম রাইটার্স সুইট কোনটা বা হেরিটেজ সুইট। বিভিন্ন প্রয়োজন অনুসারে  ভ্রমণ পিপাসুরা যাতে রিসর্টে থাকতে পারেন সেভাবেই বানানো হয়েছে। ব্যাগ পত্তর  আমাদের নির্দিষ্ট সুইটে রেখে রিসর্টের রেস্তরাঁতে চলে গেলাম মধ্যাহ্ন ভোজন সারতে।  খাওয়া দাওয়ার পরে এবারে আমাদের গন্তব্য হল মূলত কেটস পয়েন্ট এবং লড উইক পয়েন্ট। আসা যাওয়ার পথে আরো কিছু দেখব এমনই কথা ট্র্যাভেল কারের ড্রাইভারের সঙ্গে। প্রসঙ্গত বলে রাখি রিসর্টের রিসেপশন থেকেই ফোন করে গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তাই সে সব নিয়ে বেশি মাথা ব্যথা করতে হয়নি। লড উইক পয়েন্ট মহাবলেশ্বরের অন্যতম টুরিস্ট স্পট। এই লডউইক সাহেবের কথা একটু না বললেই নয়।

মারাঠা যুদ্ধের পরে ১৮১৯ এ সাতারার রাজা হলেন শিবাজীর বংশধর ২৪ বছরের প্রতাপ সিং। আর ১৮১৮ থেকে ১৮২২ পর্যন্ত সাতারা ডিস্ট্রিক্টের রেসিডেন্ট ছিলেন ক্যাপ্টেন গ্রান্ট, যিনি গ্রান্ট সাহেব বলেই সাতারায় খ্যাত ছিলেন। রেসিডেন্সি থেকে বিদায় নেওয়ার আগেই  তিনি সাতারার রাজাকে প্রতাপগড়ের  দায়িত্ব ফিরিয়ে দেন ।

এখানে বলে রাখি,প্রতাপগড় শিবাজীর বিখ্যাত কেল্লা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৫৪৩ ফিট উঁচু তে অবস্থিত। এর অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা এখান থেকে  কোঙ্কন বা আশপাশের পাহাড় পর্বত পুরোটাই নখদর্পণে রাখা যায়। এখানে রয়েছে শিবাজী প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ভবানী মন্দির আর এই কেল্লার কাছেই আফজল খানের সঙ্গে শিবাজীর মুলাকাত হয়  আর বাঘ নখ দিয়ে শিবাজী  আফজল খান কে পরাস্ত করেন। সেই প্রতাপগড়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর  ভবানী মন্দিরে পূজা দিতে যান রাজা প্রতাপ সিং । মন্দির থেকে ফেরার পথে উনি মহাবলেশ্বরের পাহাড়ে সদলবলে ক্যাম্প করে ছিলেন(সেই জায়গাটা এখন রেস কোর্স নামে পরিচিত)।

ক্যাপ্টেন গ্রান্টের পরে  সাতারার রেসিডেন্ট হয়ে আসেন কর্ণেল জন ব্রিগস  যিনি পরে জেনারেল হন। তাঁকে সেই সময় নেটিভ ইনফ্যানট্রিতে সহায়তা করবার জন্য  এসেছিলেন মেজর পিটার লডউইক,ক্যাপ্টেন ম্যাথিউস এবং লেফটেনেন্ট স্মিথ আর ছিল তিনজন সিভিলিয়ান। এরাই সেইসময় সাতারার ইউরোপিয়ান সোসাইটি তৈরি করেন।

সাতারার রাজা যখন প্রতাপগড় থেকে পূজো দিয়ে ফিরলেন সে সময়  কর্ণেল ব্রিগস আর মেজর লডউইক তাঁর কাছে সেই ভ্রমণ কাহিনী শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। মেজর লডউইক সব কাহিনী শুনে একটু বেশিই উৎসাহী হয়ে পড়েন কারন তখন সমতলের গরমে তাঁদের নাজেহাল অবস্থা। যাইহোক আরো কিছু অধস্তন  সিভিল ও মিলিটারী মিলে ছয়জন কে নিয়ে লডউইক ১৮২৪এর এপ্রিল মাসে  মহাবলেশ্বর দেখতে গেলেন আর  সেখানকার ঠান্ডা পরিবেশ থেকে  ফিরে এসে  নতুন জায়গা ভ্রমণের সব বিবরণ দিয়ে “বোম্বে কুরিয়র” এর সম্পাদক কে  “এল” নামে এক  চিঠি লেখেন যা সে সময় সকলের মাঝে খুব আগ্রহের সৃষ্টি করে।

লডউইক তাঁর চিঠিতে মহাবলেশ্বরের  আবহাওয়ার গুণগান করে নানা ভাবে সবাইকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেন যাতে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করবার জন্য এখানে কিছুদিন থাকার পরিকল্পনা করেন। বক্তব্যের সমর্থনে প্রথমদিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত যতদিন ছিলেন সেই প্রতিদিনের তাপমাত্রার একটা রেকর্ড, প্রকৃতির বর্ননা, কি কি পাখি দেখেছেন, হিংস্র পশু দেখেছেন কিনা, বর্ষা কতদিন থাকে , কোন সময়টা থাকার জন্য উত্তম ইত্যাদি সমস্ত তথ্য দিয়ে  দেন। এই চিঠি লেখার পর বেশ কিছুদিন তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা  ঘটেনি। লডউইক এরপর চলে গেলেন কিট্টুর ।

 ১৮২৫ এ কর্ণেল ব্রিগস পাহাড়ে এলেন এক দুমাস থেকে এর সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে মহাবলেশ্বরকে বোম্বে প্রেসিডেন্সির স্যানিটোরিয়াম করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন ।সাতারার রাজা প্রতাপ সিং কে রাজি করালেন মহাবলেশ্বর যাবার  জন্য  ভাল রাস্তা বানাতে। এরপরের ইতিহাসে দেখা যায় রাজা আর ব্রিগস এই দুজন মিলে যথেষ্ট যত্ন নিয়ে মহাবলেশ্বরের উন্নয়নে রাস্তা ঘাট, বাঁধ  ইত্যাদির কাজ শুরু করেন। সেইসময় বোম্বের গভর্ণর ছিলেন এলফিনস্টোন। পরে স্যর জন ম্যালকম যখন বোম্বের গভর্ণর হলেন তখন মহাবলেশ্বর কে ১৮২৯ এ স্যানিটোরিয়াম হিসেবে ঘোষণা করা হল এবং গভর্ণর সেখানে পাকাপাকিভাবে গরমের সময় নিজস্ব ভবনে থাকতে শুরু করলেন।

লডউইক পয়েন্টের কাছে যখন গাড়ি গিয়ে থামল, ড্রাইভার বলল এক দেড় কিলোমিটার সেই স্পট থেকে হেঁটে গেলে পয়েন্টে পৌঁছানো যাবে। অগত্যা পাহাড়ি সিঁড়ি বাঁধানো পথ ধরে হাঁপিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লডউইক সাহেবের সাহস আর এনার্জির কথা চিন্তা করে দ্বিগুণ উৎসাহে এগোতে থাকি। ডান দিকে খাদ আর জঙ্গল, বাঁ দিকে ঘন জঙ্গল। পথ যেন শেষ হতে চায় না! অবশেষে পৌঁছানো গেল। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪০৬৭ ফিট উচ্চতায়। ভেবে দেখলাম লডউইক সাহেব যখন এসেছিলেন তখন না ছিল রাস্তা, না ছিল মনুষ্য বসবাস করার মত ব্যবস্থা, তবু অজানা কে দেখার আগ্রহে পাহাড় জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে এসে পড়েছিলেন! একই কথা মনে হয়েছে শিবাজীর কথা ভেবে। কতটা পরিশ্রমী এবং অসম সাহসী ছিলেন যে এই পুরো মহারাষ্ট্রের দুর্গম পাহাড় পর্বতে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন! লডউইক পয়েন্টে  লডউইক সাহেবের স্মৃতিতে ২৫ ফিট উচ্চতার একটা মনুমেন্ট আছে যার চারপাশে লডউইক সাহেবের কর্মজীবন সম্পর্কিত নাতিদীর্ঘ লেখা পাথরে খোদাই করা আছে। এই পয়েন্ট থেকেই দূরে দেখা যায় কোয়না উপত্যকা,ঘাট, সরু এক চিলতে পাহাড়ি নদীর বাঁক।  পাহাড়ের ওপর  থেকে কোয়না উপত্যকা অত্যন্ত মনোরম দেখতে। পুরো পশ্চিম দিক থেকে উত্তর দিক ঘুরে পূর্ব দিকের দিকে ঘাড় ঘুরালেই চোখে পড়বে    সবুজে ঘেরা উপত্যকা। প্রাক বর্ষায় আকাশ কিছুটা মেঘলা ,কিছুটা কুয়াশা ঢাকা ছিল। তাই উপত্যকার স্পষ্ট  ছবি তোলা সম্ভব হলনা।  লডউইক পয়েন্ট দেখে এবার আরামসে উৎরাই হয়ে  আবার পার্কিং এ ফিরে এলাম।

গন্তব্য এবার কেট’স পয়েন্ট। কেট ছিলেন স্যার জন ম্যালকমের মেয়ে।কেট’স পয়েন্টের লাগোয়া আরো দুটো পয়েন্ট হল নিডল পয়েন্ট আর ইকো পয়েন্ট। কেট’স পয়েন্টে  কৃষ্ণা নদী অপরূপ রূপে কৃষ্ণা উপত্যকার বুক চিরে দৃশ্যমান । গঙ্গা গোদাবরীর পরে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম নদী কৃষ্ণা নদী । উদ্ভব মহাবলেশ্বরেই। ১৪০০ কিলোমিটারের যাত্রা পথে  মহারাষ্ট্রে এর  বয়ে চলা ২৮২ কিলোমিটার ধরে। মহারাষ্ট্রের পরে কৃষ্ণা বয়ে  গেছে কর্ণাটক,তেলেঙ্গানা আর অন্ধ্র প্রদেশ  দিয়ে। পুণ্যতোয়া এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অনেক মন্দির। কৃষ্ণা নদীর উদ্ভব স্থলে আমরা যাব আমাদের এই সফরে।

বহুক্ষণ ধরে কৃষ্ণা উপত্যকা,কৃষ্ণা নদী দেখেও যেন আশ মেটেনা। কেট’স পয়েন্টের উত্তর দিকে বয়ে চলেছে কৃষ্ণা নদী। নদীর ওপরে বালকাভাডি আর ধোম বাঁধ। কৃষ্ণা উপত্যকার পাহাড়ে প্রাকৃতিক ভাবে পাথরে অদ্ভুত ভাবে সৃষ্টি  হয়েছে একটা হাতির মাথার মতন স্ট্রাকচার, দুটো বিশাল পাথর এমন ভাবে জুড়ে রয়েছে যে  খুব স্পষ্ট ভাবেই মনে হবে হাতীর শুঁড় যেন নেমে এসেছে হাতির মাথা থেকে। এই দুই পাথরের মাঝের অংশ টিকে ছুঁচের এর ছিদ্রের মত দেখতে বলে এই পয়েন্টের নাম নিডল পয়েন্ট। মহাবলেশ্বর বলতেই যে পাহাড়ের ছবি আমরা সব সময় দেখে থাকি এ হল সেই  হাতির মাথা বিশিষ্ট নিডল পয়েন্ট বা এলিফ্যান্ট’স পয়েন্ট। আর একটু এগিয়ে গেলে রয়েছে ইকো পয়েন্ট । চিৎকার করে কিছু বললে প্রতিধ্বনিত হয়ে সেই কথাই ফিরে আসে। বেশ ক’বার চেষ্টা করলাম মেয়ের নাম চেঁচিয়ে বললাম কিন্তু কি করা! এত কমজোরী আওয়াজ যে পাহাড়ের বুকে সে ডাক রয়েই গেল!কেট’স পয়েন্ট কে ছেড়ে আসতে মন চাইছিলনা।শনশন করে বইছে হাওয়া, মাঝে দু এক পশলা বৃষ্টি , চতুর্দিকে পর্বতমালা ,নীলাভ ধুসর সবুজ রঙ ছড়িয়েছে উপত্যকা থেকে আকাশে, সমস্ত চরাচরে। মুগ্ধ হয়ে খালি দেখেই গেলাম।

ভ্রমণ সূচিতে দ্বিতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য ক্ষেত্র মহাবলেশ্বর বা পুরানো মহাবলেশ্বর। আর যাব আর্থার সীট পয়েন্ট। কিন্তু রাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি। রিসর্টে আমাদের ঘরের চালে  ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। ভোর হতেই  ঘুম ভাঙল নাম না জানা পাখির সুমিষ্ট গানে। নানা ধরণের পাখির গান, কাউকেই আর চোখে দেখতে পাচ্ছিনা কারণ বাইরে কুয়াশায়  চারপাশ সাদা হয়ে আছে। গাছের পাতা বেয়ে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে পড়ছে , আলো আঁধারিতে এক মায়াবী  রূপোলী জগত মুহূর্তেই যেন আমাদের চারপাশে তৈরি হয়ে গেল। বারান্দায় বসে সেই স্বর্গীয় দৃশ্য খালি নিঃশব্দে অনুভব করে গেলাম।মনে হল অনন্ত কাল যদি এভাবেই থমকে থাকত এই সময়! কিছু মুহূর্ত ক্যামেরা বন্দি করলাম।

বেলা একটু গড়াতে বৃষ্টি কুয়াশার খেলা চলতে লাগল। আলো উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বারেবারে ই পালিয়ে গেল। ভাবলাম হারাধনের দশটি ছেলের মত এক এক করে যদি অমূল্য দিন গুলো ঘরে বসে কেটে যায় তাহলে তো মহাবলেশ্বর দেখাই হবেনা! তাই যাই হয়ে যাক,বেরোতে হবেই, যতদূর দেখা যায় দেখে নেব। কারণ দিনের গতি প্রকৃতি মোটেই সুবিধের ঠেকছে না। পাহাড়ে  দৃশ্যমানতা কিছুই থাকবেনা বোঝা গেল। তবু সাহস করে চললাম মন্দির দর্শনে।

যা ভেবেছিলাম তাই, গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনে ঘন ঘন ওয়াইপার চালিয়েও  দশ হাত দূরের রাস্তা দেখা দুস্কর হয়ে যাচ্ছে।। এরমধ্যে আমাদের ডেস্পারেট ড্রাইভার সাঁইসাঁই করে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়েই চলেছে শুধু তাই নয় ওভারটেকও করে যাচ্ছে। যতবার তাকে বলি “ধীরে চালানা ভাইয়া”, “হামে জলদি নেহি হ্যায়” , “মরনা নেহি  হ্যায়” সে কানে তুলো  গুঁজে বলে এ রাস্তায় ত্রিশ সাল ধরে গাড়ি চালাচ্ছে রাস্তার বাঁক গুলো তার হাতের তালুর মত চেনা!চোখ বুজেও সে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারে! বুঝলাম এ যাত্রায় মানে মানে বেঁচে ফিরলেই রক্ষা! যাইহোক আমাদের রথের সারথি  ক্ষেত্র মহাবলেশ্বরে মন্দির চত্ত্বরে  আমাদের পৌঁছে দিল। এক স্থানেই তিনটে মন্দির একশ -দুশো মিটারের ব্যবধানে।

প্রথমেই গেলাম অতিবলেশ্বরের মন্দিরে। কালো পাথরে তৈরি প্রাচীন  শিবমন্দির। মন্দিরের সামনে অতিকায় নন্দীর অধিষ্ঠান। সেখান থেকে একশ মিটারের মধ্যেই রয়েছে মহাবলেশ্বর মন্দির।মন্দিরের চারপাশে পুজা সামগ্রীর  দোকানের সারি।এগিয়ে চললাম মন্দিরের প্রবেশ পথে। পনের কুড়ি মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে মন্দিরের গর্ভ গৃহে প্রবেশ করলাম। শিব লিঙ্গ এখানে রুদ্রাক্ষ রূপে পূজিত । মন্দিরটি গড়ে ছিলেন দেবগিরির যাদব বংশের  রাজা সিঙ্ঘন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। পরে শিবাজী এই মন্দির পুনরায় গঠন করেন ১৬৬৫ সালে এবং পরে বহুবার এই মন্দির পুনর্গঠন হয়েছে।সব মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পেছনে একটা কাহিনী থাকে।তেমনি এই মন্দিরের কাহিনী অনেক প্রাচীন।  স্কন্দপুরাণ অনুসারে বিশ্ব সংসার গড়ার সময় দুই অসুর ভাই অতিবল আর মহাবল  সব ব্রাহ্মণ আর দেবতাদের অতিষ্ট করে তুলেছিল। ব্রাহ্মণেরা তখন ভগবান বিষ্ণুর কাছে নালিশ জানালে তিনি অতিবল কে মারেন।সেই রাগে মহাবল দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শুরু করে। যুদ্ধ করতে করতে  ভগবান বিষ্ণু  হাঁফিয়ে ওঠেন কারণ মহাবলের কাছে ছিল ইচ্ছা মৃত্যুর বর। বিষ্ণু তখন আদি মহামায়া কে আবাহন করেন সমস্যার থেকে মুক্তির জন্য। আদি মহামায়া তখন মায়া সৃষ্টি করে মহাবলকে যুদ্ধে নিরস্ত করেন এবং মহাবল মায়ার কারণে দেখলেন দেবতারা তার কাছে আত্ম সমর্পণ করেছেন আর সেই আত্ম তুষ্টিতে তিনি দেবতাদের বললেন যে কোনো বর চাইতে। দেবতারা তখন চাইলেন মহাবলের মৃত্যু । মহাবল রাজি হলেন একটাই শর্তে, এই স্থানে দুই ভাইয়ের নামের সঙ্গে কোন ভগবানের নাম জুড়ে থাকবে সেই থেকে এইখানে মন্দিরের নাম হল মহাবলেশ্বর আর অতিবলেশ্বর ।

মহাবলেশ্বর মন্দিরের দুশো মিটারের মধ্যেই রয়েছে পঞ্চ গঙ্গা মন্দির।কোনো মন্দিরের ভেতরেই ছবি তোলার অনুমতি নেই।এই মন্দিরেই পাঁচটা নদীর উদ্গম স্থল।পাঁচটি নদী যথাক্রমে কৃষ্ণা, কোয়না,ভেন্না,গায়ত্রী আর সাবিত্রী। এই পাঁচ নদীর জল প্রথমে পাঁচটি পৃথক গহবর দিয়ে বেরিয়ে আসে পাইপের ভেতর দিয়ে, পরে এই পঞ্চ ধারাকে মিলিয়ে নিয়ে একটা গোমুখের মধ্যে দিয়ে নিয়ে আসা হয় আর সেই জল জমা হয় একটা জলাধারে। দর্শনার্থীরা সেই গোমুখের সামনে দাঁড়িয়ে পবিত্র জল সংগ্রহ করে ।এই মন্দিরকে কৃষ্ণা মন্দির ও বলে যেহেতু কৃষ্ণা নদীর উৎস স্থল এখানেই। কথিত  আছে বৃহস্পতি যখন কন্যা রাশিতে আসেন বারো বছর অন্তর তখন গঙ্গাও তার ছোট বোন কৃষ্ণার সঙ্গে দেখা করতে এখানে আসেন আর এক বছর এখানেই থাকেন। জাওলির রাজা চন্দ্র রাও মোরে  সপ্তদশ শতাব্দীতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে শিবাজী মহারাজ এই মন্দিরকে আরো বড় করেন। পবিত্র জল মাথায় ছিটিয়ে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে।

পুণ্যতীর্থ দর্শন করে আমরা এগিয়ে চললাম আর্থার’স সীটের দিকে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৪৪২১ ফিট ।এই জায়গার নামকরণ হয়েছে স্যর জর্জ আর্থারের নামে যিনি ১৮৪১ থেকে ১৮৪৬ পযন্ত বোম্বের গভর্নর ছিলেন। বৃষ্টি  সাময়িক থেমেছে কিন্তু রাস্তার অবস্থা ভয়ানক সুন্দর।কুয়াশায় ঢাকা রাস্তা চলেছে এঁকে বেঁকে, দু পাশে ঘন জঙ্গল। আর্থার সীটের  উত্তর দিকে সমস্ত পাহাড়ে ঘেরা জঙ্গল কে বলা হয় ব্রহ্ম অরণ্য। কিন্তু যতই এগোতে থাকলাম পয়েন্টের দিকে ততই বুঝতে পারলাম এ যাত্রায় আর কিছুই দেখা যাবেনা কারণ গভীর কুয়াশার চাদরে সব ঢাকা। তবু এগোলাম। টুরিস্টের বেশ  ভীড়  দেখলাম।  ক্রমাগত ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি পড়া শুরু হলে আমরা ঠিক করলাম এক দেড় কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে আর্থার’স সীটে না যাওয়াই উচিত হবে।অগত্যা অতি মায়াবী ব্রহ্ম অরণ্যের মাঝে চায়ের স্টলে গিয়ে বসে চা খেলাম তারিয়ে তারিয়ে। চারপাশে পাহাড় পর্বত উপত্যকার সৌন্দর্য্য কিছুই মালুম হলনা। চা খেয়ে সেদিনের মত যাত্রা বিরতি নিলাম, ফিরে এলাম রিসর্টে। রিসর্টের কাছেই সূর্যাস্ত দেখার একটা পয়েন্ট আছে। বোম্বে পয়েন্ট বা সানসেট পয়েন্ট।প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। সূর্যাস্ত দেখার জন্য অনেকটা জায়গা জুড়ে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যান্য ভিউ পয়েন্টের থেকে তফাত যা চোখে পড়ল এটা সবচেয়ে পুরানো ভিউ পয়েন্ট এবং মহাবলেশ্বর শহরের প্রায় কেন্দ্রে হওয়ায় ব্যবস্থাপনা ভাল। সানসেট পয়েন্টে যাবার রাস্তাও বেশ নির্জন, দুপাশেই ঘন জঙ্গল। পয়েন্টে তো পৌঁছে গেলাম, ক্যামেরা নিয়ে বন্দুক তাক করার মত প্রস্তুতিও নিলাম , কিন্তু মেঘবালিকারা সূর্যবাবুকে লুকিয়েই রাখল।কিছুতেই বেরোতে দিলনা।

মহাবলেশ্বর ভ্রমণ এবারে অনেকটাই ছিল আমাদের কাছে নিভৃতে ছুটি কাটানো। খুব বেশি দূরে ছোটাছুটি নয় বরং আরাম করে একটু অবসর যাপন।তবু তার মধ্যে থেকে অল্প বিস্তর ঘোরাঘুরি করেই ফেললাম। মহাবলেশ্বরে প্রায় সমস্ত দেখবার জায়গাই পনের থেকে কুড়িমিনিটের মধ্যে পোঁছানো যায়। এই যাত্রায় এবার বাদ পড়ে গেল প্রতাপগড় কেল্লা ।কিছুটা দূরত্বের কারণে আবার কিছুটা পাহাড়ে চড়ার ভয়ে! পরেরদিন আবহাওয়ার যথেষ্ট পরিবর্তন দেখে আমরা চললাম পাঞ্চগণির দিকে।সেই গল্প আবার পরে একদিন হবে।

2 Comments Add yours

  1. jayatisblog says:

    Thank you Suman😊.Yes I feel when I get to know the history of the place I visit it becomes more interesting to me and love to share those.I am so happy that you liked it.

    Like

  2. Suman says:

    A travel tale intertwined with those stories from pages of history book. You have created a fab piece of work. Loved every bit of it. Keep going, keep narrating for us.

    Like

Leave a comment